কখনোই পাননি ইন্ডাস্ট্রিতে প্রকৃত সম্মান,কেমন কেটেছিল জনপ্রিয় অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর শেষ জীবন?

নিজস্ব প্রতিবেদন : বাংলা সিনেমার ইতিহাসে যদি স্বনামধন্য কোন অভিনেতার নাম লিখতে বলা হয় সেখানে স্বচ্ছন্দে কিন্তু তুলসী চক্রবর্তীর নাম লেখা যেতে পারে। তার অভিনয় যেন অভিনয় ছিল না পুরোটাই ছিল একেবারে ন্যাচারাল।কোনও খাদ নেই। উচ্চকিত স্বরে গলা কাঁপিয়ে ডায়ালগ নেই। ভাঁড়ামো নেই, ন্যাকামো নেই, ছদ্ম গাম্ভীর্য নেই, তবে আছেটা কী? ওই, চোখ দু’টি। কত কথা সর্ব ক্ষণ বলে যেত তাঁর চোখ। বড় বড় বিষ্ময়ভরা ধারালো চোখের তারা নিখুঁত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলত। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমরা বলতে পারি এই অভিনেতার জীবনের বেশিরভাগ অংশই কিন্তু চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে কেটেছে। আজকের এই বিশেষ প্রতিবেদনে আমরা জেনে নেব প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর জীবনের কিছু অজানা গল্প এবং তার মর্মান্তিক পরিণতি।

একবার গাড়িতে যেতে যেতে বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় একটি দৃশ্য দেখে একেবারে চমকে উঠেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন সাদামাটা একজন অভিনেতাকে রাস্তায় বিরক্ত করছিলেন কয়েকজন যুবক। উত্তেজিত ভানু গাড়ি থামিয়ে ওই যুবকদের তাড়া করেন। এমনকি রীতিমতো হাতাহাতির মতন অবস্থা তৈরি হলে যুবকেরা পালিয়ে গেল। যুবকেরা চলে গেলে যখন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ওই মানুষটির কাছে এসে দাঁড়ালেন তখন কিন্তু রীতিমতো ধমক খেলেন। কারণ ওই মানুষটি কিন্তু বেশ করুন সুরেই বলল গায়ে হাত দিতে গেলে কেন ওরা তো আমাকে নিয়ে একটু মজাই করছিল। চিনতে পারছেন এই মানুষটিকে? শিরোনাম দেখেই তো নিশ্চয়ই চিনে গিয়েছেন। এই মানুষটি হলেন পথের পাঁচালীর সেই প্রসন্ন গুরুমশাই যিনি একসাথে মুদিখানা আর পাঠশালা চালান। ইনি হলেন স্বর্ণযুগের আইকনিক প্রতিভা তুলসী চক্রবর্তী।

এনার প্রতিভা নিয়ে রীতিমত মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন সত্যজিৎ রায়, ছবি বিশ্বাস ,উত্তম কুমার সহ আরো বহু প্রতিভাবান শিল্পী।উত্তম কুমারের একটা সময় অপপট স্বীকারোক্তি ছিল যে তুলসীদা যেভাবে অভিনয় করেন, আমি সেটা কখনোই পারবোনা। অন্যদিকে সত্যজিৎ রায় জানিয়েছিলেন এই পোড়া দেশে তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয়ের কদর কেউ করবে না। আমেরিকায় জন্মালে তিনি নির্ঘাত অস্কার পেতেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে বলেন কেউ যদি বলতে পারেন তুলসী চক্রবর্তী ওই ছবিতে খারাপ অভিনয় করেছেন তাহলে আমি লক্ষ টাকার বাজি হেরে যাব।

অর্থাৎ এক কথায় আমরা বলতে পারি তুলসী চক্রবর্তী কিন্তু ছিলেন অনেক উঁচু দরের শিল্পী। তবে বাস্তব কিন্তু ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কার্যত গোটা জীবনটাই কিন্তু অত্যন্ত দারিদ্রের মধ্যে কাটিয়েছেন তুলসী চক্রবর্তী। এমনকি তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীকে রীতিমতো ভিক্ষা করতে হয়েছিল। 300 বেশি বাংলা ছবি এবং 20টির বেশি হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। কোথাও কিন্তু তিনি নিজের প্রাপ্য সম্মান পাননি বলাই যায়। এমনকি অভাবে পড়ে তুলসী চক্রবর্তীর স্ত্রী তার স্বামীর পাওয়া সমস্ত পদক পর্যন্ত বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বর্তমান সময়ে তার বসতবাড়িটিও কিন্তু সম্পূর্ণরূপে তালা বন্ধ।

কৃষ্ণনগরের গোয়ালিগ্রাম এ জন্ম তার। অল্প বয়সে বাবা মারা গেলে মাকে নিয়ে চলে আসেন কলকাতায়।। সার্কাস থেকে শুরু করে ছাপাখানা সব জায়গাতেই অর্থ উপার্জনের জন্য কাজ করেছেন তুলসী চক্রবর্তী। অভিনয় করবেন বলে একটা সময় কিন্তু সবকিছু ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। শুধুমাত্র অভিনয় নয় এছাড়াও অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন এই শিল্পী। গান করার পাশাপাশি নাচ করতে এবং তবলা বাজাতে পারতেন তিনি। স্টার ,মনমোহন থিয়েটারসহ একাধিক জনপ্রিয় থিয়েটারে তাকে দেখা গিয়েছে। ৪০ টিরও বেশি নাটকে অভিনয় করার পর যখন তার পরিচিতি তৈরি হয় তখন তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য ডাক পান।

১৯২০ সালে তিনি দুর্গেশনন্দিনী নামক প্রথম নাটকে অভিনয় করেছিলেন। তার প্রথম অভিনীত চলচ্চিত্র হলো পুনর্জন্ম। এরপর ধীরে ধীরে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন তুলসী চক্রবর্তী। নিয়মিত অভিনয় করলেও এই বাণিজ্যিক দুনিয়ায় কিভাবে দর বাড়াতে হয় সেই খেলা সম্ভবত তিনি জানতেন না।সিনেমায় অভিনয় করার প্রথম ৭-৮ বছর বাদ দিলে তার পরের প্রত্যেক বছর নিয়ম করে তুলসি বাবুর ৩-৪টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। ১৯৫৪ সালে তুলসি বাবুর ১১টি সিনেমা মুক্তি পায় এবং ১৯৫৫ সালে মুক্তি পায় ১৩টি। সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতে তার অভিনয় এখনো কিন্তু দর্শকেরা মনে রেখেছেন। অন্যদিকে তুলসী চক্রবর্তী অভিনীত পরশপাথর ছবিটি ও কিন্তু ভোলার মতো নয়। বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করতে অনেক ছবিতে কিন্তু ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করতে বাধ্য হয়েছেন এই অসাধারণ শিল্পী। বরাবর থেকেই তিনি ছিলেন নির্লোভ আর আমুদে প্রকৃতির মানুষ।

যা চরিত্র নিয়ে তাঁর কাছে যেতেন তিনি সম্মতি দিতেন এবং নিয়ম করে শুটিংয়ে যেতেন। কখনও পারিশ্রমিকের কথা মুখ ফুটে বলতেন না। চাইতেনও না। অনেকেই তাঁর যোগ্য দূরস্থান, তিনি যতটা টাকা নিতেন সেটা না দিয়েই কাজ করিয়ে নিতেন। এমন ঝুরি ঝুরি অভিযোগ রয়েছে। জীবনে কখনও পারিশ্রমিক বাড়াননি। আসলে ছোট থেকে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে বড় হওয়ার সুবাদে হয়তো একটা ভয় তাঁর মধ্যে কাজ করত। তিনি ভাবতেন, যদি পারিশ্রমিক বাড়ালে আর ডাক না আসে। জাত অভিনেতা ছিলেন, তাই অভিনয় করেই সুখ পেতেন। ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে কিন্তু কখনোই তিনি বিন্দুমাত্র চিন্তিত ছিলেন না।

উত্তম কুমার থেকে শুরু করে বহু মানুষ তাকে নানান সময়ে সাহায্য করতে চাইলেও তুলসী চক্রবর্তী কিন্তু কখনো সেই সাহায্য নেন নি। শোনা যায় একটি ছবিতে অভিনয়ের জন্য মহানায়কের কথায় যখন পরিচালক তাকে বেশি পারিশ্রমিক দিতে চেয়েছিলেন তিনি কিন্তু সেটাও গ্রহণ করেননি। এমনকি সত্যজিৎ রায় যখন পরশপাথর ছবিতে তাকে মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের কথা বলেন সেই সময় কিন্তু রীতিমত কেঁদে ফেলেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। জানা যায় সত্যজিৎ রায় যখন পরশপাথর ছবির প্রস্তাব নিয়ে তুলসী চক্রবর্তীর বাড়িতে যান তখন পারিশ্রমিকের অংক শুনে তার হাত ধরে রীতিমত কেঁদে ফেলেছিলেন এই শিল্পী।

যা দেখে সত্যিজিৎ খানিকটা বিব্রতই হয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, তুলসি চক্রবর্তীর যা পারিশ্রমিক হওয়া উচিত তা তিনি দিতে পারছেন না। তাও এই পারিশ্রমিকের কথা শুনে ভদ্রলোকের চোখে জল! শুটিং চলাকালীন বাড়ি থেকে স্টুডিও যাতায়াতের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। কিন্তু খানিকটা ভয়েই সে প্রস্তাবে সায় দেননি তুলসি। তিনি সত্যজিৎ রায়কে বলেওছিলেন, ‘না রে বাবা, আমার ট্রাই ভালো। গাড়িতে চেপে স্টুডিও এলে প্রযোজকরা ভাববে তুলসি বুঝি রেট বাড়িয়ে দিল। ওরা আর কাজে ডাকবে না আমায়।’ হিরোর রোল করেও এর কম টাকায় অভিনয় করার জন্য সত্যজিৎ তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেও এত কম টাকায় রাজি হলেন কেন?’ জবাবে তুলসি সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন।

স্বল্প পারিশ্রমিকের কাছ থেকেই তিনি তার দৈনন্দিন আহার পেতেন। ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে তার মধ্যে যে ভয়টা তৈরি হয়েছিল সেটা কখনোই কিন্তু তাকে জীবনে এগিয়ে যেতে দেয়নি। তবে একথা আমরা বলতেই পারি প্রথমবার সত্যজিৎ রায় কিন্তু এমন ব্যাক্তিত্ব ছিলেন যিনি তুলসী চক্রবর্তীর শিল্পীসত্তার সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন। একটি বিশ্বমানের ছবিতে তুলসী চক্রবর্তীকে মুখ্য চরিত্রের জন্য বেছে নিয়েছিলেন তিনি। এমনকি একটা গল্প শোনা গিয়েছিল তাকে নিয়ে। জাদরেল অভিনেতা ছবি বিশ্বাস সাধারণত একবার স্ক্রিপ্টেই চোখ বুলিয়ে ছেড়ে দিয়ে নিজের মতন করে অভিনয় করতেন। কিন্তু একবার যখন তুলসী চক্রবর্তীর সামনে বসতে দেখা গেল তখন কিন্তু সমস্ত কিছু ছেড়ে দিয়ে ছবি বিশ্বাস বললেন জলদি করে স্ক্রিপ্ট নিয়ে আসতে তিনি পড়বেন।। তাকে প্রশ্ন করলে ছবি বিশ্বাস উত্তর দিয়েছিলেন তুলসী রয়েছে যে যদি কিছু ভেবে নেয়।

আজ প্রায় ১৬০ বছর পেরিয়ে গেছে তুলসী চক্রবর্তীর জন্মদিনের। অনেকেই কিন্তু নিঃসন্তান তুলসী চক্রবর্তীর বাড়িটি সংস্কার করার দাবী জানিয়েছেন।ইতিহাস তাঁর সঠিক মূল্যায়ন করতে পারলেও যাঁরা পুরস্কার দিয়ে থাকেন, তাঁরা হয়তো এ সবের থেকে দূরেই থাকেন। তুলসি চক্রবর্তীকে কোন পুরস্কার দিলে তাঁকে সঠিক সম্মান দেওয়া হবে সেটা জানা নেই, তবে তাঁর নামে যদি কোনও পুরস্কার শুরু করা যায় তবে যে কোনও শিল্পী তা পেলে গর্ববোধ করবেন, নিঃসন্দেহে বলা যায়। এই প্রসঙ্গে আপনাদের কি মতামত তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন। কিংবদন্তি অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর সম্পর্কিত আমাদের আজকের এই বিশেষ প্রতিবেদন ভালো লেগে থাকলে অবশ্যই তা লাইক আর শেয়ার করে নেবেন।

ভিডিওটি দেখতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন- https://youtu.be/wEk_0FUIP9U

Leave a Comment