







নিজস্ব প্রতিবেদন: চল্লিশের দশকের শুরুতেই বাংলা সিনেমার জগতে আবির্ভাব হয়েছিল অভিনেত্রী ভারতী দেবীর। জ্যোতিপ্রকাশ, অসিত বরন এবং উত্তম কুমারদের মতন অভিনেতাদের সঙ্গে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল তার জুটি। তবে সিনেমায় নামার আগে অল্প বয়সেই তার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। এরপর শ্বশুর বাড়িতে ভয়াবহ অত্যাচারের শিকার হন তিনি।নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েই একটু একটু করে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আজকের এই বিশেষ প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা জেনে নেব ভারতী দেবীর সংগ্রামের গল্পের পাশাপাশি তার জীবনের কিছু অজানা কথা।
১৯২২ সালের ২৩ শে অক্টোবর কলকাতার এক বিত্তবান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ভারতী দেবী। পিতা হরেন্দ্রকৃষ্ণ দাসের দ্বিতীয় স্ত্রী পদ্মাবতীর মেয়ে সে। তার নাম ছিল মহামায়া। পাঁচ থেকে ছয় বছর বয়সেই তবলা বাজানো শুরু করেছিল সে। একটু বড় হয়েই সেতার, বাঁশি প্রভৃতি বাজানো শেখেন তিনি। অত্যন্ত আনন্দের মধ্যেই ছোট্ট মহামায়ার দিন কাটছিল। যখন তিনি ক্লাস সিক্সে উঠলেন তখন সেই আনন্দের দিন আচমকায় শেষ হয়ে গেল। বারাণসীতে বিয়ে হয়ে যায় তার। স্কুল ছেড়ে এবং নিজের বাড়ি ছেড়ে বারানসিতে চলে যান তিনি।




আপনজনদের ছেড়ে বারানসীর পরিবেশ তার একদমই ভালো লাগতোনা বলা যায়। তার স্বামী ছিলেন দারুণ অত্যাচারী। অল্পতেই রেগে যেতেন,শুধুমাত্র তাই নয় প্রচণ্ড মারধর করতেন।বাপের বাড়ির কথা বললে যখন মহামায়া উদাস হয়ে যেত, তখন তার স্বামী ভাবতো পরপুরুষের প্রেমে পড়েছে সে। তারপর আরো অত্যাচারের পরিমাণ বেড়ে যেত। নানাভাবে তার উপর মানসিক আর শারীরিক অত্যাচার যখন চরমসীমায় পৌঁছে গেল, তখন বিধ্বস্ত মহামায়া তার বাবা মাকে সবকিছু খুলে বলেন।
কিন্তু সেসব শুনে তার স্বামী আরো রেগে গেলেন। মহামায়ার থেকে বিচ্ছেদ চাইলেন তিনি। তবে সেই সময় বিচ্ছেদ ব্যাপারটা ভারতীয়দের কাছে কিন্তু বেশ অচেনা ছিল। এমনকি হিন্দু বিবাহ আইনে বিবাহ বিচ্ছেদের ব্যাপারটাও ছিল না। তবে অন্য ধর্মে এই আইন থাকায় উকিলের পরামর্শ অনুযায়ী প্রথমে মহামায়ার ধর্ম পরিবর্তন করা হয়। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তিনি সেলিমা বিবি নাম ধারণ করেন। বিবাহ বিচ্ছেদের পর আবারও হিন্দু ধর্মে ফেরত আসেন মহামায়া। অনেক কষ্টে সংসার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পান তিনি।




এই সময় মামলা আর ব্যাবসায়িক বিপর্যয়ে সর্বশ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন তার বাবা। তারপর ১৭ বছর বয়সেই মহামায়াকে তার বাবার বন্ধু বিষ্ণুচরন রায়চন্দ বড়ালের বাড়ি নিয়ে যান। রায়চাঁদ বড়াল ছিলেন তখন ডাকসাইটে সুরকার এবং নিউ থিয়েটারস এর একজন অন্যতম সদস্য।তার সুপারিশে মহামায়া মাত্র ১০০ টাকা বেতনে নিউ থিয়েটারসে কাজ পেয়ে যান। সেখানেই নাম বদলে মহামায়া হয়ে যান ভারতী দেবী। তার প্রথম ছবির নাম ছিল ডাক্তার, ১৯৪০ সালে মুক্তি পেয়েছিল এই ছবি।
ছবিটি দারুন হিট হওয়ায় ভারতী দেবীর জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগলো। এরপর অভিনেতা অসিত বরণের সঙ্গে জুটি বেঁধেছিলেন তিনি। এই অসিত বরণ ছিলেন ভারতী দেবীর ছোটবেলার খেলার সঙ্গী। চার বছরের মধ্যেই ভারতী দেবীর বেতন ১০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়ে যায় ৫ হাজার টাকা। ১৯৫১ সালে সহযাত্রী ছবিতে তিনি মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে জুটি বেঁধেছিলেন। এরপর অমর মল্লিকের দুর্গেশনন্দিনী ছবিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি লাভ করেন ভারতী দেবী। এর বছর তিনেক বাদেই মনের ময়ূর ছবিতে উত্তম কুমারের বিপরীতে দেখা যায় তাকে।




তবে ততদিনে ছবিটা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। শুরু হয়ে গিয়েছে উত্তম যুগ। চলে এসেছেন সুচিত্রা সেন এবং সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মতন অভিনেত্রীরা। এরপর নায়িকা হওয়ার দিন ফুরিয়ে যায় ভারতী দেবীর। তিনি মুখ্য চরিত্র ছেড়ে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করতে শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে পরশপাথর, তারপর সাগর সঙ্গমে, নির্জন সৈকতে প্রভৃতি ছবিতে জমিয়ে অভিনয় করেছিলেন তিনি। এই সময় বেশ কিছু পুরস্কার লাভ করেন তিনি। তারপর আবার নায়ক ছবিতে উত্তম কুমারের সঙ্গে কাজ করেছিলেন তিনি।
তবে সেটাও ছিল একটি পার্শ্ব চরিত্র।। গল্প হলেও সত্যি, পথে হল দেরি, আজকের নায়ক, চোখের বালি, পলাতক, চাওয়া পাওয়া প্রভৃতি বহু ছবিতে অভিনয় করেছেন ভারতী দেবী। বাংলা ছাড়া তিনি বেশ কিছু হিন্দি ছবিতেও কাজ করেছেন। ১৯৭৫ সালে ঢাকুরিয়া তে বাড়ি ফিরে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন তিনি। প্রথম জীবনের যন্ত্রণার ছাপ তার শেষ জীবনে কিন্তু আর ছিল না। ২০১১ সালে বার্ধক্য জনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। তবে তার অভিনয়ের মাধ্যমে আজও মানুষের হৃদয়ে গেঁথে রয়েছেন ভারতী দেবী। এই অভিনেত্রীকে আপনাদের কেমন লাগে তা কিন্তু অবশ্যই আমাদের সঙ্গে কমেন্ট বক্সে শেয়ার করে নিতে ভুলবেন না।











