স্বামীর মৃত্যুর পর তাড়িয়ে দেওয়া হয় বাড়ি থেকে! চরম আর্থিক সংকটে কাটে শেষ জীবন, অভিনেত্রী সন্ধ্যারানীর মর্মান্তিক পরিণতি কাঁদাবে সকলকেই

নিজস্ব প্রতিবেদন: দীর্ঘ ৬০ বছরের অভিনয় জীবন এবং প্রায় ২৫০টিরও বেশি ছবিতে অভিনয়, যেকোনো আবেগপ্রবণ চরিত্রে পরিচালকের প্রথম পছন্দ ছিলেন সন্ধ্যারানী। শুধুমাত্র নিষ্ঠার জোরে যে কোন ধরনের চরিত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। হিন্দি ছবিতে যেমন নিরুপা রায় মায়ের ভূমিকা তে বিখ্যাত,তেমনভাবেই অসংখ্য বাংলা ছবিতে মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করে বিখ্যাত ছিলেন সন্ধ্যা রানী। আজকের এই বিশেষ প্রতিবেদনে আমরা আপনাদের সঙ্গে এই কিংবদন্তি অভিনেত্রীর জীবনের কিছু অজানা দিক শেয়ার করে নেব।

১৯২২ সালের ১১ই আগস্ট জন্ম হয়েছিল এই অভিনেত্রীর। তার আসল নাম আঙ্গুর। ছোটবেলা থেকেই দিদিমার কাছে মানুষ তিনি।চরম দারিদ্র্য এবং অভাবের সংসারে বড় হয়ে উঠেছেন সন্ধ্যা রানী। সংসারের চাহিদার প্রয়োজনেই একটা সময় তিনি পৌঁছে যান নাট্য জগতে। প্রথম নাটক ছিল ‘মহানিশা’। বালিকা নৃত্যশিল্পী হিসেবেই তিনি জীবন শুরু করেছিলেন। ১৯৩৮ সালের দুটি ছবিতে প্রথম দেখা যায় তাকে। ছবি গুলির নাম ছিল সার্বজনীন বিবাহ উৎসব এবং বেকারনাশুন। ১৯৪১ সালে নরেশচন্দ্র মিত্রের চলচ্চিত্র বাংলার মেয়ে’তে প্রথমবার বড়ো ভূমিকায় অভিনয় করেন সন্ধ্যারানী।

এসময়েই পরিচালক নরেশচন্দ্র মিত্র তার নাম রেখেছিলেন সন্ধ্যারানী। তারপর বেশ কয়েকটি ছোটখাট আর গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করতে থাকেন তিনি।যেমন ১৯৪১ সালে উত্তরায়ন, উতলা প্রভৃতি। পরিনিতা ছবিতে প্রথমবার নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। এরপর সমাধান ছবিতে অভিনেতা রবিন মজুমদারের নায়িকা হয়েছিলেন সন্ধ্যারানী।

শরৎচন্দ্রের লেখা বহু ছবিতে অভিনয় করেছেন বলে তাকে শরৎচন্দ্রের মানস কন্যা ও বলা হতো। নিষ্কৃতি, সব্যসাচী, বিন্দুর ছেলে, জয়া, দেবদাস, বৈকন্ঠের উইল, দেনা পাওনা, বড় দিদি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। শরৎচন্দ্রের লিখিত বিভিন্ন ছবিতে প্রথমে নায়িকা এবং পরে চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবেই কাজ করেছেন তিনি। মহানায়ক উত্তম কুমারের সাথেও বহু ছবিতে অভিনয় করেছেন সন্ধ্যা রানী।

প্রথমে মহানায়কের নায়িকা এবং পরবর্তীতে তিনি মহানায়কের মা। উত্তম কুমারের সাথে তার অভিনীত ছবিগুলির মধ্যে সঞ্জীবনী, মন্ত্রশক্তি, বিধিলিপি, ব্রতচারীনি, কঙ্কাবতীর ঘাট, পৃথিবী আমারে চায়,মায়ামৃগ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। একবার শুটিংয়ের সময় এক পরিচালক সন্ধ্যারানীকে দারুন অপমান করেছিলেন। তিনি তখন অনেক কেঁদেছিলেন এই অপমান সহ্য করে যা একেবারেই পছন্দ করেননি উত্তম কুমার। এরপর উত্তম কুমার সেই পরিচালককে ক্ষমা চাইতে বলেন এবং পরিবর্তে শুটিং বন্ধ রাখেন। পরিচালক সন্ধ্যারানীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার পর শুটিংয়ের কাজ শুরু হয়েছিল।

সন্ধ্যা রানীর স্বামীর নাম অলোক চট্টোপাধ্যায়। প্রথমে বউবাজারের কাছে থাকলেও পরে ল্যান্স ডাউন রোড এর উপর, বিরাট তিন তলা বাড়ি তৈরি করেন তারা। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা চলাকালীন সময়ে একটি মুসলমান পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তিনি। দাঙ্গা কারীরা বাড়িতে আক্রমণ করা সত্ত্বেও তিনি আশ্রিত পরিবারটিকে তাদের হাতে তুলে দেন নি।স্বামীর মৃত্যুর পর তথাকথিত আপনজনদের অত্যাচারে এই বাড়ি তাকে ছাড়তে হয়। তারপর ফার্ম রোড এর কাছে একটি বাড়িতে থাকতে শুরু করেন তিনি।

স্বভিমানী এই অভিনেত্রী নিরবে নিভৃতে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। খুব ধার্মিক আর সন্ন্যাসিনীর মতন জীবন যাপন করতেন তিনি। শেষ জীবনে মাথার সমস্ত চুল কেটে অত্যন্ত দীন দরিদ্রের মতন থাকতেন একসময়ের এই জনপ্রিয় অভিনেত্রী। কোনরকম সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি আর যোগ দিতেন না শেষের দিকে। জীবিকার প্রয়োজনে অভিনয় করলেও একসময় নিজেকে ফিলমি জগৎ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলেন নায়িকা। একমাত্র অভিনেত্রী শোভা সেনের সঙ্গে চিরকাল মধুর সম্পর্ক ছিল তার।

পুত্র আশীষ কে কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া ছিল তার মৃত্যুর পর দাহকার্য সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে যেন খবর না দেওয়া হয়। ১৯৯৯ সালের ১৯শে জুলাই ৭৭ বছর বয়সে প্রয়াত হন সন্ধ্যারানী। বর্তমানে অভিনেত্রীর পুত্রের বয়স প্রায় ৭০ এর উপরে। পরিবারকে নিয়ে অভিনেত্রীর ফার্ম রোডের বাড়িতেই বসবাস করেন তারা। আজকের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা স্বর্ণযুগের এই জনপ্রিয় কিংবদন্তি অভিনেত্রীকে শ্রদ্ধা জানাই। ইহলোক ত্যাগ করলেও তার অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শক সন্ধানীকে সারা জীবন মনে রাখবে।

Leave a Comment